
ওয়ার্ল্ডভিউ বনাম প্রফেশনালিজম
ড. মোহাম্মদ ওমর ফয়সল।
আমরা যে চোখে বিশ্ব দেখি..
পৃথিবীর সকল আয়োজন মানুষের জন্যই। মানুষ আল্লাহর কুদরতি হাতে বানানো এক অপরূপ আশ্চর্য সৃষ্টি, সর্বোত্তম আকৃতির অধিকারী। বিভিন্নভাবে মহান প্রভু এ জাতিকে দিয়েছেন মর্যাদার সর্বোচ্চ আসনটি।
‘বিনা অপরাধে যে একজনকে মারলো, সে যেনো জগতের সকলকেই মারলো। আর যে একজনের প্রাণ বাঁচালো, সে যেনো জগতের সকলের প্রাণ বাঁচালো’। ( আল-কুরআন ৫:৩২)
প্রতিটি মানুষের চেহারা-আকৃতি যেমনি স্বতন্ত্র, সম্পূর্ণ আলাদা; ঠিক তেমনি তার ওয়ার্ল্ডভিউ বা চিন্তাদর্শনও..। সুবিশাল বরফখন্ডের অতি সামান্য অংশ যেমনি পানির উপরে ভেসে থাকে, ঠিক তেমনি মানুষের চিন্তা- দর্শনের সামান্য অংশই তার ব্যক্তিত্ব কিংবা আচার-আচরণ হিসেবে প্রকাশ পায়।
ব্যক্তি তার নিজের সম্পর্কে, নিজের জীবন সম্পর্কে এবং এই বিশ্বটা সম্পর্কে যে চিন্তাগুলো হৃদয়ে লালন করে,সেগুলোর সমষ্টিই ব্যক্তির বিশ্বদর্শন বা ওয়ার্ল্ডভিউ। প্রত্যেকে ভাবে/ চিন্তা করে নিজের মতো করে, তার ওয়ার্ল্ডভিউর আলোকে, তার আকল অনুসারে।
বাংলায় সুন্দর একটা গল্প আছে, এক দুষ্ট চোর সারারাত চুরি করে পুকুরের একঘাটে ফ্রেশ হতে আসে, পুকুরের অপর ঘাটে এক তাহাজ্জুদ গুজার আসেন অজু করতে। চোর ভাবে, ‘এই এলাকায় আমি একা চোর নই; ঐ ঘাটে তো আরেকজন পানি নাড়াচ্ছে- সেও নিশ্চয়ই চোর। আর তাহাজ্জুদ গুজার ভাবেন, হায় আল্লাহ ! তোমার আরেক পেয়ারা বান্দা ঐ ঘাটে অজু করে তাহাজ্জুদের জন্য যাচ্ছেন। আমি একা তাহাজ্জুদ গুজার নই। উভয়ের চিন্তা-দর্শন আলাদা। চোর আর তাহাজ্জুদ গুজারের চিন্তাভাবনা বা ওয়ার্ল্ডভিউ সম্পূর্ণ ভিন্ন।…
‘ বল, ‘প্রত্যেকেই স্বীয় রীতি-পন্থা (ওয়ার্ল্ডভিউ) অনুযায়ী কাজ করে। কিন্তু তোমার রাব্ব ভাল করে জানেন, কে সর্বাপেক্ষা নির্ভুল পথে আছে। (আল-কুরআন-১৭:৮৪)
ওয়ার্ল্ডভিউ হলো চিন্তার এমন একটি কাঠামো যার মাধ্যমে/ সাপেক্ষে আমরা বাস্তবতাকে বোঝার চেষ্টা করি। আমাদের ওয়ার্ল্ডভিউ-ই ঠিক করে দেয় বাস্তবতাকে আমরা কীভাবে দেখি, বুঝি কিংবা ব্যাখ্যা করি।
ওয়ার্ল্ডভিউ হলো চিন্তার ভাষা। প্রত্যেকের যেমন নিজস্ব ভাষা থাকে, তেমনিভাবে প্রত্যেকের একটা ওয়ার্ল্ডভিউ থাকে৷ ওয়ার্ল্ডভিউ হলো সেই লেন্স, সেই চশমা যার ভেতর দিয়ে আমরা পৃথিবীকে দেখি।
যাক বলছিলাম, ব্যক্তির ওয়ার্ল্ডভিউ কিভাবে প্রফেশনালিজমকে প্রভাবিত করে সে কথা। মানুষের ওয়ার্ল্ডভিউর মধ্যে উচিত-অনুচিত মিশ্রিত থাকে। ব্যক্তি যদি নীতি ও ন্যায্যতার বিষয়ে গভীর অধ্যয়ন, প্রশিক্ষণ, অভ্যাস, পাঠদান, নিরন্তর সাহচর্য ইত্যাদির মাধ্যমে তার ওয়ার্ডভিউ-কে উন্নত করে তাহলে সেটা আচার-আচরণ হিসেবে তার পেশা বা কর্মক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। ব্যক্তি তার ওয়ার্ল্ডভিউকে মরণের আগ পর্যন্ত উন্নত করার প্রচেষ্টা চালাতে পারে।
সিমেন্টের পিলার থেকে আঙ্গুরের থোকা আশা করা যেমনি অবাস্তব; ঠিক তেমনি ব্যক্তি চিন্তা-ফিকির কিংবা যথার্থ জ্ঞান অর্জন ব্যতীত তার ওয়ার্ল্ডভিউকে উন্নত করা ঠিক তেমনি অসম্ভব। তাইতো, বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেছেন,’দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করো’।
আমি কে? আমার কী আছে, কী নেই? কোনটা বাস্তব, কোনটা অবাস্তব? এলাম কোথা থেকে? যাব কোথায়? করছি কী? কী করবো, কী করবো না? জ্ঞান কী, জ্ঞানের উৎসগুলো কী? জ্ঞানের মানদণ্ড কী? জীবন কী? জীবনের উদ্দেশ্য কী? ভালোমন্দের মাপকাঠি কী? এই মাপকাঠি অনুযায়ীর্তি কীভাবে মানুষের বেঁচে থাকা উচিত? কোন নীতির ভিত্তিতে সমাজ চলবে? আইনের উৎস কী হবে? শাসনের ভিত্তি কী হবে?
– মৌলিকভাবে প্রত্যেক ব্যক্তি ও সভ্যতা এই জিজ্ঞাসাগুলোর জবাব খুঁজেছে। এগুলো মানব অস্তিত্বের মৌলিক প্রশ্ন। এই প্রশ্নগুলোর ব্যাপারে প্রত্যেক ব্যক্তি সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও দর্শনের কিছু নির্দিষ্ট উত্তর এবং মাপকাঠি থাকে। এগুলোর সমন্বয়ে গঠিত হয় তার ওয়ার্ল্ডভিউ।
ব্যক্তির নৈতিক মানের ভিত্তি হলো তার ওয়ার্ল্ডভিউ। যার চিন্তাদর্শন/ওয়ার্ল্ডভিউ যত প্রখর, দূরদর্শী, যৌক্তিক ও বুদ্ধিদীপ্ত হবে তার পেশাগত দায়িত্ব পালনও ঠিক তেমনি সর্বোচ্চ মানের হবে।
ওয়ার্ল্ডভিউ/বিশ্ববীক্ষণ একটি সম্পূর্ণ উচ্চমার্গীয় একাডেমিক বিষয়। এ নামে হয়তো অনেকে বিষয়টিকে জানেন না। তবে মানুষের জীবন তার ওয়ার্ল্ডভিউকে ঘিরেই নিত্য আবর্তিত হচ্ছে।
ইসলামের রয়েছে স্বতন্ত্র একটি ওয়ার্ল্ডভিউ- যার মৌলিক ভিত্তি হচ্ছে তাওহীদ, খিলাফাত ও আদালত। মানুষকে মানুষ হতে হলে তার ওয়ার্ল্ডভিউ ঠিক করতে হয়। আর এই কাজটি তত সহজ নয়। তাইতো বলা হয়.. The toughest task for human is to humanize.
Dr. Muhammad Omar Foysal